You are here

সেদিন ছিল জ্ঞানের দেবী সরস্বতী পুজোর কয়েকদিন আগের জোগাড় যন্তর

সেদিন ছিল মানুষের জ্ঞানের দেবী সরস্বতী পূজোর কয়েকদিন আগের দিন

ইমেজ ক্রেডিট: কলকাতার ছবিওয়ালা @ pexels

9/1/2024 মেদিনীপুর, সকাল

গ্রাম শহরের মাঝে দুটি কচি প্রাণের মানুষের জ্ঞানের দেবী সরস্বতী পুজোর আকাঙ্খা

মানুষের জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। সকলের মনের মধ্যেই তিনি আছেন। দেবীমূর্তিকে যখন নমস্কার করে অঞ্জলির ফুল ছুঁড়বে, সে ফুল পড়বে মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা দেবির পায়ে।

কাল Toto করে ইকো পার্ক থেকে বেরোচ্ছি, শীতের সূর্য প্রায় অস্তাচলে। মনে খুশি নেই। এই পার্কে একটু পাহাড়ি জঙ্গল আছে শুনেছিলাম। কিন্তু সোনাঝুরি আর ঝাউগাছ দিয়ে কি আমার ভালোবাসার সালজঙ্গল হয়!

ওই আগাছা ভরা একটু পাহাড়ি এলাকা শেষে রাস্তা নামল শহরতলীর সমতল পিচ রাস্তায়। সামনে চোখ পড়ল। রাস্তার ধারে এক খুঁটিতে বাঁধা রাস্তা জুড়ে একটা বাঁশ। অবরোধ তোলার দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে এক কিশোর। বড় জোর বয়স বার কি তের হবে। মুখের সরলতা এখনও যায় নি। ফ্রক পরা আরও ছোট একটি মেয়ে এগিয়ে এল আমার থেমে যাওয়া Toto র দিকে। করুণ মিনতি ভরা স্বরে বলল, আমরা সরস্বতী পুজো করব। একটু চাঁদা দিয়ে যান।

মুখ পানে চাইলাম। আমার নাতনি থাকতে পারত এমন একটি। বললাম, আমি কোন মন্দিরে ঢুকি না। সরস্বতী পুজো কোনদিন করি নি। কোন পুজোয় চাঁদা দিই না। বাড়িতে তোমাদের দিদা দেয়। তবু তোমরা একটু আনন্দ করবে তাই দিচ্ছি। কিন্তু সবচেয়ে কম।

দশটাকা দিলাম। আজকের দিনে দশটাকার আর কি দাম!

বাঁশের গেট উঠল। ওদের মুখে ফুটল একটু হতাশা আর একটু খুশি মেশান এক চিলতে হাসি। আমার মনে কেন জানি একটা কাঁটা ফুটে রইল। ছোট্ট এক কাঁটা।

আজ সকালে সন্তোষ সেনগুপ্তর অতুলপ্রসাদ শুনছিলাম, নিচুর কাছে নিচু হতে শিখলি না রে মন, তুই সুখী জনের করিস পূজা দুখির অযতন..;

অতুলপ্রসাদ এর অবিনশ্বর গান শুনতে শুনতে আবার ফিরে গেলাম সেই ক্ষণে। সেই বাঁশ ফেলা গেটের পিছনে বন্ধ রাস্তায় দাঁড়ান Toto তে। মনে মনে বলছিলাম আমার মনের কথা। কাল যা বলার ছিল গুছিয়ে ওদের আমায়। এইরকমই হয় বারে বারে। যা বলার ছিল তা বলা হয় মনে মনে সময় পেরিয়ে গেলে।

আমার কখনোই সময়ে কথা বলা হয় না, হয় সময় পেরিয়ে গেলে

আমার সেই না বলা কথা, 'সরস্বতী পুজো খুব ছোটবেলায় হত আমাদের বাড়িতে। ছোট্ট একটি সুন্দর মূর্তি ফুলে সাজিয়ে সামনে বসে মা বই দেখে মন্ত্রপাঠ করতেন। আমার ছোটবোন আর দিদি খুব মন দিয়ে শুনত আর নিচুস্বরে মন্ত্রগুলি বিড়বিড় করে আওড়াত। ছোট্ট মুঠোয় একটু ফুল নিয়ে তিনবার অঞ্জলি দিতাম। একটু আলাদা হয়ে থাকলেও খুশি থাকতাম। তারপর প্রসাদ মুখে দিয়ে ছুট্টে বেরিয়ে পড়া। আজ খালি ছুটি আর ছুটোছুটি।

আর একটু বড় হতে তখন বাতাসে ফুলের গন্ধ। প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি। ফুল ফুটে চারধারে। বসন্ত আসছে। সে এক অপূর্ব আনন্দের দিন। সরস্বতী পুজোর দিন। পুজোটা উপলক্ষ।

আরও পরে তফাতে থেকে অন্যদের আনন্দ উপভোগ করতাম। আর কখনও দেবদেবীর মূর্তিকে নমস্কার করি নি।

সরস্বতী মানুষের বিদ্যা আর জ্ঞানের দেবী। বড় সুন্দর সে দেবী কল্পনা। তোমাদের মনের মধ্যেই তিনি আছেন। ঘুমিয়ে আছেন। বাইরের দেবীমূর্তিকে যখন নমস্কার করে অঞ্জলির ফুল ছুঁড়বে, সে ফুল পড়বে তোমার মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা দেবির পায়ে।

সরস্বতী, লক্ষী, দুর্গা, শিব সবাই আছেন তোমাদের সকলের মধ্যে। বাইরের মূর্তিতে নয়। সেদিন সারা বাংলা সারা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ সরস্বতী পুজো। অতগুলো দেবী কি করে হবেন। দেবী একই, বিদ্যা ও জ্ঞানের অপরূপ এক রূপ, যে রূপকে তিনি চান তোমাদের সকলের মধ্যে। তোমাদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সেই রূপ সেই গুণের পূজা কর। মনপ্রাণ দিয়ে। তিনি জাগবেন, তোমাদের মধ্যেই। পৃথিবী সেই আগামী দিনে বিনম্র জ্ঞানে আনন্দে ছেয়ে থাকবে।

পুজোর দিনে পুজো কর। আনন্দে মেতে থেকো সেদিন। তারপর তোমার যে কাজ মনপ্রাণ দিয়ে কর। বিদ্যা, জ্ঞান, বিনম্রতা নিজের করে নাও। আর চারপাশের সকলের মধ্যে চারিয়ে দাও। সারাজীবন। সবদিন। কেবল একটা দিনই নয়।

বিদ্যা ও জ্ঞান স্কুল কলেজ থেকে যা শিখবে সে শুধু একটুখানি।  আসল জ্ঞান নেবে আপন করে আপন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। জীবনের অভিজ্ঞতার চেয়ে  বড় গুরু কেউ নেই। জানা কখনও থামবে না, প্রশ্ন করাও।

প্রশ্ন না করলে জানবে না, প্রশ্ন প্রবাহের শেষ হবে মনোমত উত্তর পেলে, সেই হলো তোমার নিজের জ্ঞান

'কেন?' এ প্রশ্নের মনোমত উত্তর না পেলে প্রশ্ন করেই যাবে যতক্ষণ না উত্তর পাও। যদি তুমি যাদের চেন তারা উত্তর দিতে না পারে, নিজেকেই প্রশ্ন করো।

চারপাশের মানুষের কথা ভাববে, তারা কিসে আনন্দ পায়, কিসে দুঃখ। কেন সূর্য অস্ত যায় আবার দিন হয়। সারা পৃথিবী জুড়ে ঘড়ির কাঁটা একই সময় কেন দেয় না, প্রশ্নের কোন শেষ আছে? প্রশ্ন চলবে, জানা চলবে সারাজীবন। দেখবে কম বয়সে যে উত্তর পেয়েছিলে, আরও বয়স হতে সে উত্তর পাল্টে যায়। এ বড় আশ্চর্য।

জানার কোন শেষ নেই। তেমনি চারপাশের সবাইকে জানানোরও। তোমার জানা যদি আর সকলকে শিখিয়ে দাও, তোমার জানা যেমন অনেক বেড়ে যায়, তেমনি সব মিলিয়ে সবার জানাও কত যে বেড়ে যায় তোমরা ভাবতেও পারবে না।

জ্ঞান শুধু নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখলে তার কোন দাম নেই। যেমনি ব্যাংকে যত টাকাই রাখ, তার উপযুক্ত ব্যবহার না করলে সে টাকার দাম কাগজের দামের চেয়েও কম।

জ্ঞান ও অর্থ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াতেই সব মানুষের, পৃথিবীরও অক্ষয় জীবন

যখন জ্ঞান আর অর্থ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবে, ততই তার দাম যেন অসীম হবে। সকলের আনন্দ যেমন তোমায় আনন্দ দেবে সে আর কিছুতে পাবে না। এই অপূর্ব অবাক করা মানুষের জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী।

জেনে আর জানিয়ে, সারাজীবন ধরে আনন্দে পুজো করে যাও সকলের মধ্যে থাকা সেই দেবীকে।

এখন তোমাদের সবে জীবন শুরু হয়েছে। আনন্দ করে সরস্বতী দেবির পুজো কর সেদিন। কিন্তু তারপরেই শুরু হবে আসল পুজো। তোমার সমস্ত ক্ষমতা আর অনুসন্ধিৎসা দিয়ে জ্ঞান অর্জন তোমাকেই করতে হবে। নিজে নিজে, চেষ্টা করে। প্রতিদিনই সেই জ্ঞানের পুজো। সারাজীবন ধরে। মূলজ্ঞানের।

আজ তোমাদের মুখভরা হাসি দেখতে চাই। পাঁচশ টাকা দিলাম। ভাল থেকো, আনন্দে থেকো। ভালো রেখো, আনন্দে রেখো।'

জ্ঞানের দেবী সরস্বতী 

জ্ঞানের দেবী সরস্বতী হচ্ছেন হিন্দু ধর্মের বিদ্যা, জ্ঞান, শিক্ষা ও কলার দেবী। তিনি বীণাপাণি। তাঁর হাতে থাকে বীণা, কলা ও সংস্কৃতির প্রতীক। সরস্বতী পূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের বিদ্যার্থীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, আর বাঙালির ঘরে ঘরে সরস্বতী পূজা হয়ে আসছে বহু দশক ধরে। এই পূজা বাঙালি হিন্দুদের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে আজ এক সর্বজনীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের রূপ নিয়েছে।

কিন্তু সরস্বতী পূজায় জাঁকজমক কম, শুধু ছোট একটুখানি মূর্তি হলেই হলো আর মন্ত্রপাঠেও কোনো আড়ম্বর নেই। না থাকারই কথা। শত হোক তিনি জ্ঞানের দেবী, ধনের নয়। আর মানুষের শ্রেষ্ঠ ধন তো জ্ঞানই। মুক্ত জ্ঞান। তিনি শুধু জ্ঞানের পূজা আর অন্তরের একনিষ্ঠতা চান, যা ভক্তিরই আর এক রূপ। তাই মন্ত্রপাঠ বা জাঁকজমকের আড়ম্বর তিনি চান না।

জ্ঞান, বিদ্যা আর কলার সমাহার আছে বলেই তো সে মানুষ, অন্য সব জীবের চেয়ে আলাদা।

সরস্বতী সকলের দেবী। এই দেবির রুপকল্পনা যিনি করেছিলেন আদিকালে, তাঁকে নমস্কার।

আরও জানো

১০৮ নাম দেবী সরস্বতীর ও পূজা মন্ত্র ও পদ্ধতি

এই নামগুলি দেবীর জ্ঞান, সঙ্গীত, কলা ও বুদ্ধির রূপ

সরস্বতী পূজা, মন্ত্র ও পদ্ধতি

এই দেবীর পূজা সরল। মন্ত্র ও পদ্ধতি জানো।

দেবী সরস্বতীর পূরাণের কাহিনী

মা সরস্বতীর উল্লেখ একেবারে সেই ঋগ্বেদ। সরস্বতী নামের মানে, 'নিজেকে জানা'। আশ্চর্য হবার উপায় নেই। জ্ঞানের পথে প্রথম ধাপই হল নিজেকে জানা। সরস্বতী বাগদেবি, মানুষের শব্দ উচ্চারণের দেবী, শব্দ উচ্চারণকে মানা হয় আদি শক্তির রূপ হিসেবে। বেদে ওম শব্দই সৃষ্টির প্রতীক।

সরস্বতীর চারহাতের এক হাতে আছে পদ্মফুল, সত্যজ্ঞানের প্রতীক, এক হাতে তাঁর আছে পবিত্র পুরাণ, আর দুই হাতে তিনি বীণা বাজিয়ে জীবনের সঙ্গীত আকাশে, বাতাসে, মানুষের মনে অনবরত সুর তোলেন।

দেবীকে নিয়ে অনেক কাহিনী। তিনি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কন্যা আবার পত্নীও বটেন। কিন্তু তিনি শুদ্ধজ্ঞানের প্রতীক শ্বেতবসনা দেবী সরস্বতী। তিনি পূজিত হন সারা ভারতে, দেশে বিদেশে। তাঁরই শাপে, ব্রহ্মা পূজিত হন না একেবারে।

বেশ কিছুটা আরো জানতে পারবে এখানে।