You are here

ফেব্রুয়ারীতে এপ্রিলের গরম: বিশ্ব উষ্ণায়ন ও আবহাওয়া বিশৃঙ্খলা

ফেব্রুয়ারীতে এপ্রিলের গরম: বিশ্ব উষ্ণায়ন ও আবহাওয়া বিশৃঙ্খলা

ছবির উৎস: AndreasAux at Pixabay

(এ গল্প ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসের)

ফেব্রুয়ারির গরম যাই হোক, সূর্য নিজের নিয়মে চলছে। দিন রাত আনা সে নিজের ছন্দেই করছে, আমরা অতিক্ষুদ্র মানুষেরা যা-ই করি না কেন, সে তার নিজের নিয়মেই চলবে।

ফেব্রুয়ারীতে এপ্রিলের গরম দিন

গতকাল বেলা একটু বাড়তেই আমি কাছের দোকান থেকে কিছু কিনতে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় পা দিতেই গরমের হলকা লাগল। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালাম, আকাশের দিকে তাকালাম—এত গরম!

বয়েস অনেক হল। আমাদের দেশের গরমে আর অত সহজে বিচলিত অবাক হই না। সয়েও যায়। তবে ঠান্ডা? হ্যাঁ, অবশ্যই ঠান্ডা আগের চেয়ে বেশি লাগছে এখন। কিন্তু গরম? গরমে আমার এখনও অসুবিধে হচ্ছে না। তবু একটু উত্তেজিত হয়ে পড়লাম।

দোকানে পৌঁছে দেখি, ছেলেটা ব্যস্ত, কাস্টমার সামলাচ্ছে। অদ্ভুত এই উত্তেজনায় আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি কখনও ফেব্রুয়ারিতে এমন গরম দেখেছ?"

আজকালকার ছেলেরা আমাদের সময়ের তুলনায় বেশি ভেবেচিন্তে কথা বলে। ও কোন উত্তেজনা দেখাল না। শান্ত স্বরে উত্তর দিল, "কাকু, আমরা ভুলে যাই গত বছর কতটা গরম ছিল, কিংবা ধরুন তিন বছর আগে কেমন ছিল।" গরমের কথা না বলে এবার তার উত্তর একদম অন্যদিকে মোড় নিল, "কাকু, আপনি কি এখন দশ বছর আগের মতো সবজি পান?"

ছেলেটা বেশ ভেবেচিন্তে কথা বলে তা জানতাম, কিন্তু এমনভাবে এড়িয়ে যেতেও জানে আশা করিনি। ওর কথা মানতে হলো। সে হেসে বলল, "তাহলে আপনি কিভাবে আশা করেন ফেব্রুয়ারির গরম দশ বছর আগের মতো হবে? হবে না তো! সব কিছুই বদলে যাচ্ছে। আবহাওয়া আরও গরম হওয়ার হাজারটা কারণ আছে। কোলকাতা কেমন দূষিত হয়ে গেছে দেখুন!" আবার আমাকে একমত হতে হল।

আমি বুঝলাম সে আসলে আমার সঙ্গে একমত, কিন্তু তার শঙ্কাগুলো ওপর ওপর, এখন কি হচ্ছে, আর সেটা কি ভবিষ্যৎ বোঝায়, তা নিয়ে অত ভাবে না। সময়ও নেই তার ভাবার।

আমি তাকে দোষ দিতে পারলাম না। সে তো এখনও তরুণ। এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে অনেক বেশি দিন থাকতে হবে তাকে। বয়স হলে সে বুঝবে কত তাড়াতাড়ি বদল আসছে যার কোনটাই শুভ নয়।

বাড়ি ফেরার পথে সেই অস্বস্তি কিছুতেই কাটছিল না। আমি একেবারে নিশ্চিত, এমন গরম আমার এত বছর বয়সে, কলকাতার ফেব্রুয়ারিতে কখনও দেখিনি।

বাড়িতে ঢুকেই ছেলেকে সামনে পেয়ে একই প্রশ্ন, "বাইরে কী গরম! আমি কোনদিন ফেব্রুয়ারিতে এমন গরম দেখিনি। মনে আছে, মার্চের শুরুতে আমরা জঙ্গলে গিয়েছিলাম? কত দিন কাটিয়েছিলাম খোলা জঙ্গলে। কোন অসুবিধেই হয়নি।" সে খুব শান্ত স্বভাবের, মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ।" বেশি কথা বলে না ও। পাশ কাটিয়ে গেল বুঝলাম। যারা ব্যস্ত তাদের কি এসব ভাবার সময় আছে? আমি তখনকার মত ওই অস্বাভাবিক উত্তেজনা থেকে মনকে সরিয়ে দৈনন্দিন কাজে মন দিলাম।


দুপুর শেষে সন্ধ্যে নামল হঠাৎ—আমার বোঝবার আগেই

স্নান সেরে, দুপুরের খাবারের পর বিছানায় বসে কাজ করতে করতে কখন যেন বিকেল হয়ে গেল, খেয়ালই করিনি। সব জানালা খোলা ছিল, আলো কমে আসছিল আস্তে আস্তে, আমি লক্ষ করিনি। কতক্ষণ ধরে কাজ করছি? আশ্চর্য! ঘড়ির দিকে তাকালাম। আরে, মাত্র ৪টা ৪৫। এপ্রিল মাসে তো এত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হওয়ার কথা নয়!

ওই মুহূর্তেই রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। এ এক বিশাল বিশ্বজোড়া বিস্তৃত গরমিল। সকালে গরমের প্রভাব আমার ওপর এতটাই পড়েছিল আমি মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম এটা এপ্রিল। পারিপার্শ্বিক ভুলে। নিশ্চিত এটা বয়সের লক্ষণ—পরিবেশের ব্যাপারে ভুলে যাওয়া। এটা তো মাত্র ফেব্রুয়ারি, দিনও ছোট। খেয়ালই করি নি। ফেব্রুয়ারিতে এপ্রিলের গরমে অস্বস্তি হলেও সন্ধ্যে তো তাড়াতাড়ি হবেই। এ সূর্যের নিয়ম। দিনরাত্রি তার নিয়মে হয়, সে অত দূরে থাকলেও। মনের ভিতর ভয়ের ছোঁয়া লাগল। এরপর কি হবে? আরও কিছুদিন গেলে?

এ তো বিশ্ব উষ্ণায়ন ও আবহাওয়া বিশৃঙ্খলা। অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের পূর্বাভাস।

তারপর অবশেষে শান্তি নামল। নতুন এক জ্ঞানে।

ফেব্রুয়ারির গরম যাই হোক, সূর্য কিন্তু নিজের নিয়মে চলছে। দিন আর রাত আনার কাজটা সে নিজের ছন্দেই করছে, আমরা অতিক্ষুদ্র মানুষেরা যা-ই করি না কেন, সে তার নিজের নিয়মেই চলবে। এই পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটসমগ্র কি ভাবছে কি করছে তার কোন তোয়াক্কা না রেখেই।

সূর্য প্রকৃতির নিয়িন্ত্রক। আগুনে গরমে, জলের অভাবে ঝড়ে ঝঞ্ঝায়, শুকিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে হয়ত আসন্ন সময়ে বেশিরভাগ প্রাণের বিনাশ হবে। তখন মানুষের এই বিষময় প্রভাব থেকে মুক্তি পেয়ে প্রকৃতি আবার নতুন সবুজে বেঁচে উঠবে। সূর্যের হাত ধরে।


শেষের কথা

সেদিন ছিল ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীর এক দিন।। ছোট এক অঙ্কুর-লেখ লিখেও ফেলেছিলাম—The Sun is Beyond Us. ক'দিন ধরেই বড্ড গরম লাগছিল, এই ২০২৪ এর অক্টোবরের শুরুতেও। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীর পর আরও সাড়ে আট বছর কেটেছে। এখন সবার মনেই দেখি আশঙ্কা। কেউ জানে না কিভাবে এ গতি কি করে ফেরানো যায়।

আর ভার না বাড়িয়ে শুধু কয়েকটা এ বিষয়ের ওপর লেখার লিঙ্ক দিলাম।

এই দশকের মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এবং আগামী দশকের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা:

  1. পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকার পরিবর্তন: বঙ্গোপসাগরের জলস্তরের বৃদ্ধি এবং সুন্দরবনের ক্রমশ সংকুচিত হওয়া ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বঙ্গোপসাগরের জলস্তর প্রতি বছর গড়ে ৭ মিলিমিটার বাড়ছে, যার ফলে ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণও বেড়েছে। গত ৫০ বছরে ১০টি দ্বীপের ক্ষতি হয়েছে, এবং আগামী দিনে এই প্রভাব আরও বাড়তে পারে।
  2. ২০২৩ সালের IPCC রিপোর্ট: বিশ্ব উষ্ণায়ন ইতিমধ্যে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে, এবং যদি এই হারে কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৩০-এর দশকে এই তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির উপরে উঠে যেতে পারে। এর ফলে বন্যা, তাপপ্রবাহ, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের বৃদ্ধি আরও তীব্র হবে, যা জীববৈচিত্র্য এবং মানবস্বাস্থ্যের বড় ধরণের ক্ষতি করবে।
  3. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পূর্বাভাস: স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় (Artificial Intelligence বা AI ব্যবহার করে) বলা হয়েছে, বর্তমান হার বজায় থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে বনভূমির মৃত্যু এবং সুবৃহৎ বরফের চাঙ্গড় আরও তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে সমুদ্রস্তর বেড়ে উপকুলের অনেক শহর ডুবিয়ে দিতে পারে।

এগুলো আগামী দশকের জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতির সামান্য কয়েকটা আভাস।